যানজটে নাকাল ঢাকাবাসী, সড়কে পুলিশ থেকেও নেই!

 

যানজট রাজধানী ঢাকার প্রতিদিনকার দৃশ্য। তবে যানজটের পুরনো চিত্র যেন দিনকে দিন আরও প্রকট আকার ধারণ করছে। ঢাকাবাসীর জীবন থেকে প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় কেড়ে নিচ্ছে এই যানজট। সড়কের মোড়ে মোড়ে পর্যাপ্ত ট্রাফিক পুলিশ থাকলেও কেন এই যানজট নিরসন করা সম্ভব হচ্ছে না, এমন প্রশ্ন নগরবাসীর।

যানজটে নাকাল ঢাকাবাসী, সড়কে পুলিশ থেকেও নেই?



শেখ হাসিনার পতনের পর থেকেই আদায়ের লক্ষ্যে কিংবা বৈষম্য নিরসনে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সড়কে নামছেন। শুধু দাবি আদায় না, সভা-সমাবেশ কিংবা মানববন্ধন যেন এখন সড়কের নিত্যদিনের দৃশ্য। আর এতে করে নগরজুড়ে ট্রাফিক সিস্টেমের স্থবিরতা।


হাসিনা সরকার পতনের পর পুলিশ এবং সাধারণ জনগণের মধ্যকার সম্পর্কে ব্যাপক টানাপোড়ন পড়ে। আর এতে করে বেশ কিছুদিন কর্মবিরতির পর সড়কে পুলিশ নামলেও তাদের মধ্যে আগের মতো কর্মস্পৃহা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না, এমনটাই অভিযোগ করছেন নগরবাসী। নগরীর বাসিন্দাদের অভিযোগ পুলিশ যদি আগের মতো সড়কে কাজ না করে তবে এই যানজট দিনকে দিন বেড়েই চলবে।

বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা আরেফিন বলেন, সড়কে দিনকে দিন যানজট বেড়েই চলছে। আগের চেয়ে বেড়েছে এই যানজট। পর্যাপ্ত ট্রাফিক পুলিশ সড়কে যেন থেকেও নেই। তারা আগের মতো ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে না। আগে যেভাবে তারা সড়কে দায়িত্ব পালন করতেন এখন অনেকটা তারা নীরব দর্শকের মতো দায়িত্ব পালন করছেন।

একই অভিযোগ করে উবার চালক রফিক মিয়া বলেন,
 

ঢাকায় যানজট অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেড়েছে। আসলে পুলিশের আগে উপরি আয় ছিল, এখন তো তা বন্ধ, তাই তারা আগের মতো কাজ করে না। পুলিশ এখন ঘুষও নেয় না, কাজও করে না। তারা যদি ঠিক মতো কাজ করে তবে এই যানজট দূর করা কঠিন কিছু না। পুলিশের ঠিক মতো কাজ না করাই এই যানজটের মূল কারণ।


তবে এই অভিযোগ অস্বীকার করে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) খ. নাজমুল হাসান সময় সংবাদকে বলেন, পুলিশ আগের চেয়েও অনেক বেশি কর্মস্পৃহা নিয়ে নতুন উদ্যমে কাজ করছে। সড়কে যানজট নিরসনে আমরা কাজ করছি। যানজটের জন্য পুলিশ কখনোই দায়ী না। এখানে বেশ কিছু বিষয় কাজ করছে।

 

তিনি বলেন, সড়কে এখন প্রায় দেখা যায় দাবি আদায়ের জন্য বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এক হচ্ছেন। এতে করে সড়কের ট্রাফিক সিস্টেমে ব্যাঘাত ঘটে। এছাড়া ব্যাটারিচালিত রিকশা এখন সড়কে উঠে যাচ্ছে, তবে আমরা তাদের প্রতিহতের সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। আমরা শুরুতে কয়েক দফা তাদের বুঝিয়েছি, কয়েক দফা তাদের ওয়ার্নিং দিয়েছি, এখন আমরা মামলা দিতে বাধ্য হচ্ছি।

তিনি আরও বলেন, ব্যাটারিচালিত রিকশার পাশাপাশি বেশ কিছু লাইসেন্সবিহীন বাস সড়কে উঠে যাচ্ছে, আর এতে যানজট বাড়ছে। আমরা এই লাইসেন্সবিহীন বাসগুলোকে সড়কে উঠা থেকে প্রতিহত করছি। আগামী শনিবার বাস মালিকদের সঙ্গে বেশ কিছু বিষয় নিয়ে বসব। ১২৮টি রুটে যে বাস চলে যেই বাস চালকদের আমরা সচেতন করতে কাজ করব। আরেকটি বিষয় হচ্ছে ৫ আগস্টে পর কাভার্ড ভ্যানগুলো সড়কে নেমে যাচ্ছে আর এসবে কারণেও ট্রাফিক জ্যাম বেড়েছে। এই বিষয়টি নিয়েও আমরা সর্বোচ্চ কাজ করছি।

বিশেষজ্ঞদের মতে, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, যত্রতত্র পার্কিং, ফুটপাত দখল, গাড়ির তুলনায় রাস্তার স্বল্পতা, রাজধানীকেন্দ্রিক শিল্পকারখানা স্থাপন, ট্রাফিক ব্যবস্থাপকদের অদক্ষতা, দুর্নীতি ও অনিয়ম, পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনার অভাব, আইনের বাস্তবায়ন না হওয়া, আইন-আদালত, সচিবালয়, টার্মিনাল, স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব অফিস ঢাকার মূল পয়েন্টগুলোতে স্থাপনের কারণে সৃষ্টি হচ্ছে যানজট।

‘ওয়ার্ল্ড ট্রাফিক ইনডেক্স-২০১৯’-এ প্রকাশিত সূচকের তথ্যমতে, বিশ্বে যানজটপূর্ণ শহরের তালিকার শীর্ষে ঢাকা। এ শহরে একটি গাড়ি ঘণ্টায় মাত্র পাঁচ কিলোমিটার যেতে পারে। বর্তমানে যানজটের কারণে কর্মঘণ্টার যে অপচয় হচ্ছে এর ক্ষতি বছরে ৩৭ হাজার কোটি টাকার মতো।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাবেক সাধারণ সম্পাদক নগর পরিকল্পনাবিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) নগর ও অঞ্চল বিভাগের অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন,
 

ঢাকার দীর্ঘদিনের সমস্যা যানজট। এই সমস্যা ধীরে ধীরে বাড়ছে। ২০ বছর আগেও ঢাকার যানবাহনের যে গতি ছিল সেই গতি ধীরে ধীরে কমছে। আর যানবাহনের ধীরগতি পুরো নগরে জন্ম দিচ্ছে স্থবিরতার। বিগত দিনগুলোতে যানজট সমস্যা নিরসনে যেসব উদ্যোগ নেয়া হয়েছে সে উদ্যোগগুলো স্মার্ট ছিল কি না তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।


তিনি বলেন, ঢাকার যানজট নিরসনে ২০০৫ সালে কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা (এসটিপি) প্রণয়ন করে সরকার। ২০০৫ সালের সেই প্ল্যানটাকে যদি বাস্তবায়ন করা যেত তাহলে ২০২৪ সালে এসে অনেক উন্নতি করার কথা ছিল। অর্থাৎ যানজট বাড়ার কথা ছিল না। কিন্তু সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।


ঢাকার ফুটপাত নিয়ে এই নগর পরিকল্পনাবিদ বলেন, মেগাসিটি ঢাকার ট্রান্সপোর্ট সমস্যা সমাধানের কৌশল হিসেবে ঢাকায় হাঁটার যে জায়গা অর্থাৎ ফুটপাতগুলো চলাচলের জন্য আরও সুগম করার প্রয়োজন। বাস সার্ভিস আরও জনবান্ধব করা উচিত। এগুলো এসটিপির আওতায় ছিল; কিন্তু বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি।

ঢাকায় ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার বড় অভাব রয়েছে জানিয়ে ড. আদিল বলেন,
 

বিশ্বের অনেক বড় বড় শহরেই যানজট দেখা যায়। কিন্তু সেটা পরিমিত লেভেলের। কিন্তু ঢাকার যানজট বড় সড়ক থেকে শুরু করে অলিগলিতে ছড়িয়ে পড়ে। ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা যদি সঠিকভাবে করা যায়, তবে যানজট নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।


তিনি বলেন, গত পাঁচ-সাত বছরে ঢাকায় মোটরসাইকেলের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। যেখানে প্রাইভেট গাড়ি কমানোর কথা, সেখানে প্রতিনিয়তই গাড়ির সংখ্যা বাড়ছে। এক্সিসটিং রোড এত গাড়ির ভার নিতে পারছে না। মেগা সিটি মানেই প্রচুর গণপরিবহন; কিন্তু সেই গণপরিবহনের মাত্রা কিন্তু বাড়ছে না। গণপরিবহন যত ভালো করা যায়, ততই প্রাইভেট গাড়ির প্রতি অনাগ্রহ তৈরি হবে এবং তারা গণপরিবহনে যাতায়াত করবে।

Post a Comment

0 Comments